সবগুলোকে এরেস্ট করতে বলছিলাম তো।
এবার আর কোনো কথা নাই। এবার একবারে শুরুত্তে দিবা।”
এখন লেথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সোজা গুলি করবে।
নেত্র বিশ্লেষণ

শেখ
হাসিনার
নিজ
জবানীতে

|

Sheikh Hasina audio call records

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আইন-প্রয়োগকারী বাহিনীগুলো যেভাবে নির্বিচারে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছিল, তার পূর্ণাঙ্গ খতিয়ান ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।

রাজনৈতিক সরকারের তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা ওই সময় কঠোরভাবে আন্দোলন দমনের হুঙ্কার দিলেও, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এখন তাদের কণ্ঠে ভিন্ন সুর। এত এত প্রাণহানির দায় কেবল গুটিকয়েক অতিউৎসাহী পুলিশ সদস্যের উপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন দলটির নেতারা।

কিন্তু খোদ শেখ হাসিনার বেশ কয়েকটি ফোনালাপের রেকর্ডিং সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। সেখান থেকে ইঙ্গিত মিলেছে যে, শুরু থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন মোকাবেলার প্রতিটি পদক্ষেপে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন হাসিনা।

মধ্য জুলাই থেকে শুরু হওয়া এসব ফোনালাপে হাসিনার কণ্ঠে কখনো রাগ, উদ্বেগ, আর কখনো বিরক্তির আভাস পাওয়া যায়। আবার কখনও কখনও তাকে কড়াভাবে নির্দেশ দিতেও শোনা যায়। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার যে তার জ্ঞাতসারে ও নির্দেশে হয়েছিল— এই রেকর্ডিংগুলো শোনার পর তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে কমই।

এসব কথোপকথনের বেশ কয়েকটি স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের দিয়ে যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হয়ে প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি, আল জাজিরাসহ ঢাকার ডেইলি স্টার পত্রিকা। কিছু রেকর্ডিং প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকের ফেসবুক প্রোফাইলে। আমরা এই রেকর্ডিংসমূহ শুনেছি ও বিশ্লেষণ করেছি। তবে স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারিনি। এই রেকর্ডিংয়ের সূত্র কী, তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থার আড়িপাতা থেকে কিংবা ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তির মোবাইলে কলগুলো রেকর্ড হয়েছে। এসব রেকর্ডিং এখন সরকারি কৌঁসুলিদের হস্তগত হয়েছে।

এই কথোপকথন থেকে এমন একজন প্রধানমন্ত্রীর চিত্র ফুটে ওঠে, যিনি বিক্ষোভকারীদের সহ-নাগরিক হিসেবে নয় বরং হুমকি হিসেবে দেখেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে প্রকাশ করা প্রতিবেদনে তার আদেশ-সম্বলিত একটি বাক্য হুবহু উল্লেখ করা হয় — “আন্দোলনের হোতাদের গ্রেপ্তার কর। মেরে লাশ লুকিয়ে ফেলো।”

ফাঁস হওয়া কথোপকথনগুলোতে সেই ক্ষোভেরই যেন কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়।

এই প্রতিবেদনের জন্য মন্তব্য চেয়ে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র মোহাম্মদ আরাফাতের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেত্র নিউজ। এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত তার কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হাসিনার ছাপ

২০২৪-এর জুন মাসে উচ্চ আদালত সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় দিলে সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ের প্রথম থেকেই তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে তারা।

১৪ জুলাই এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জেরে শেখ হাসিনা স্বভাবসুলভ কণ্ঠে প্রশ্ন রাখেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেনো? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না। তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?” তার ওই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীরা ফুঁসে ওঠে। রাতভর “তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার” স্লোগানে প্রকম্পিত হয় ক্যাম্পাস।

সেদিন ঠিক মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মাকসুদ কামালের সঙ্গে ফোনালাপ হয় হাসিনার। এই ফোনালাপের বিবরণ আদালতে পড়ে শোনান আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একজন কৌঁসুলি। বিবরণ অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। তার ভাষ্য, “এদেরকে বাড়তে বাড়তে তো...রাজাকারদের কী অবস্থা হয়েছে দেখিসনাই, সবগুলাকে ফাঁসি দিছি, এবার তোদেরও ছাড়ব না।”

হাসিনার এই আস্ফালনে গলা মেলান আওয়ামী লীগ-ঘেঁষা শিক্ষকদের নেতা ও ভাইস চ্যান্সেলর মাকসুদ কামাল।

হাসিনা এরপর হুঙ্কার দিয়ে বলেন, “এইগুলাকে [বিশ্ববিদ্যালয় থেকে] বাইর করে দিতে হবে...আমি বলে দিচ্ছি আজকে সহ্য করার পরে অ্যারেস্ট করবে, ধরে নেবে এবং যা অ্যাকশন নেওয়ার নেবে...কারণ ইংল্যান্ডে এ রকম ছাত্ররাজনীতির জন্য মাঠে নামল, কতগুলি মেরে ফেলায় দিল না?”

এই কথোপকথনের একদিন যেতে না যেতেই “মেরে ফেলায়” দেওয়ার সূচনা ঘটে।

১৬ জুলাই চট্টগ্রামে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের হামলায় নিহত হন তিন জন। ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকায় ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে অন্তত দুইজন মারা যান। একইদিন দুপুরে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ।

সারাদেশে ছাত্রদের উপর হামলা ও হত্যার খবরে ১৬ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। হলে হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

১৭ জুলাই সকালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বের করে দেয় বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা। পনের বছরেরও বেশি সময় ধরে নিয়ন্ত্রণে থাকা এসব হলে অবস্থান হারিয়ে বিপাকে পড়ে যায় ছাত্রলীগ।

সেদিন ঠিক সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে হাসিনার সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের।

ইনানের বক্তব্যে স্পষ্ট যে মাঠপর্যায়ের কৌশল নির্ধারণে সম্পৃক্ত ছিলেন খোদ হাসিনা নিজে।

ইনান
হাসিনা
ইনান
“ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে আসছে, ছেলেদের হল অধিকাংশই ফাঁকা হইছে, তবে এরপরেও ভিতরে পুলিশের সার্চ করতে হবে। আমাদের দলীয় সিনিয়ররাও অনেকে প্যানিকড হয়ে যাচ্ছিল, মানে কী করবো ডিরেকশন দিতে পারতেছেননা। এজন্য আজকে আপনারে বারবার ফোন দিচ্ছি, আপনি কিছু মনে কইরেন না।”

“আমি কেন মনে করবো? আমিতো সেদিন সারা রাতই জাগা। কালকেওতো। দক্ষিণে, উত্তরে বলে দিসে যেখানে যা দরকার আমিতো বলেইছি। নেতারা ঘাবড়ায়ে যায়।”

“আমাদের নেতাকর্মীরাও মাঠে ছিল। আপনার নির্দেশনা পাইয়াই সবাই নাইমা গেসে।”

অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের আক্রমণের নির্দেশনাও আসে সরাসরি হাসিনার কাছ থেকে।

প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের ফরমায়েশ

১৮ই জুলাইয়ের মধ্যে আন্দোলন মারাত্মক রূপ নেয়। সন্ধ্যার মধ্যে অন্তত বিশজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া যায়। গুলিবিদ্ধ হন শতাধিক, যাদের অনেকেই পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিংবা সুচিকিৎসার অভাবে মারা যান। সেদিন ৫৩ জন নিহত হওয়ার বিষয় নেত্র নিউজ স্বতন্ত্রভাবে নিশ্চিত করে। হাসিনার সঙ্গে সেদিন রাত ১০টা ২১ মিনিটে কথা হয় তার ফুফাতো ভাই ও ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের। তার এই ফোনালাপের বিভিন্ন অংশ যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে প্রকাশ করেছে বিবিসি, আল জাজিরা, অস্ট্রেলিয়ার এবিসি নিউজ ও ঢাকার ডেইলি স্টার

হাসিনার বক্তব্য থেকে সেখানে স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে কীভাবে মৃতের সংখ্যা অকস্মাৎ এত বৃদ্ধি পায়।

হাসিনা ততক্ষণে তার সব বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন — “সবগুলিকে অ্যারেস্ট করতে বলসি রাত্রে। র‍্যাব, ডিজিএফআই — সবাইকে বলা হইসে, যে যেখান থেকে যে কয়টা পারবা ধরে ফেল।”

কিন্তু তাপস তাতে ভরসা পাননি। হাসিনার সরাসরি নির্দেশনা চেয়ে তিনি বলেন, “আপনার নির্দেশনা লাগবে।” কীসের জন্য হাসিনার নির্দেশনা প্রয়োজন, সেই ব্যাপারে তাপস খোলাসা করে কিছু না বললেও হাসিনা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন। জবাবে তিনি জানান, সেই বিষয়ে ইতিমধ্যে তার “ওপেন নির্দেশনা” দেওয়া আছে।

তার পাল্টা ভাষ্য, “না, আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিসি একদম। এখন লেথাল উইপেন ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সোজা গুলি করবে। ওদের বলে দেয়া আছে।”

প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে হাসিনার ওই অনুমোদন ও নির্দেশনার পর বাড়তে থাকে লাশের মিছিল। পরদিন মোট ১৭৯ জন নিহতের সংখ্যা নেত্র নিউজ নিশ্চিত করেছে। পুরো আন্দোলনে একক কোনো দিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নিহত হয় ১৯ জুলাই।

তাপসকে সেদিন তিনি আশ্বস্ত করে আরও বলেন, “যেখানেই গ্যাদারিং দেখবে সেখানেই উপর থেকে... এখন উপর থেকে করাচ্ছি। অলরেডি শুরু হইছে কয়েকটা জায়গায়। শুরু হয়ে গেছে।”

“উপর” থেকে তিনি কী করাচ্ছেন, তার আরও স্পষ্ট ব্যাখ্যা কিছুটা পরেই দিয়ে দেন তিনি — “ড্রোন দিয়ে ছবি নিচ্ছি, আর হেলিকপ্টারে ইয়ে হচ্ছে, মানে কয়েক জায়গায়...”

হেলিকপ্টার নিয়ে হাসিনার বক্তব্য শেষ না হতেই বাগড়া দেন তাপস। কিন্তু এই বিষয়ে হাসিনার বক্তব্য আরও স্পষ্টভাবে উঠে আসে নিজের জোটসঙ্গী ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে হওয়া তার একটি কথোপকথনে। এই কল রেকর্ড প্রকাশ করেন সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। নারায়ণগঞ্জের একটি উদাহরণ টেনে হাসিনা বলেন, “ওরা ব্যারিকেড দিয়ে আছে তো? ঠিক আছে। আকাশ থেকে নামবে। দুই পাশ দিয়ে ধরবে। ওটার মেসেজটা দিয়ে দিতে পারেন। যে ছত্রীসেনা পাঠানো হচ্ছে। হেলিকপ্টার দিয়ে সোজা বোম্বিং করা হবে। র‍্যাবের হেলিকপ্টার যাচ্ছে। উপর দিয়ে মারবে।”

হাসিনা ও ইনুর এই ফোনালাপের রেকর্ডিং আমরা স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করিনি।

আন্দোলন মোকাবেলায় “প্রোপাগান্ডা” কীভাবে চালাতে হবে, তা নিয়েও বিশেষ পরামর্শ ছিল পোড় খাওয়া বাম নেতা ইনুর।

ইনু
হাসিনা
ইনু
“আমি একাত্তরে আটটার সময় যাব। একা কথা বলব। আমি বলব যে সরকারের সঙ্গে কোটা আন্দোলনকারীর কোনো বিরোধ নাই। সরকারের সঙ্গে বিরোধ হচ্ছে নাশকতাকারী বিএনপি-জামাতের।”

“ওটাতো বলা আছে। এটা আমি নিজেও বলসি, কাদেরকে বলাইছি।”

“এই জিনিসটা প্রোপাগান্ডায় আনতে হবে।”

ইনু হাসিনাকে জানিয়েছিলেন, তিনি একাত্তর টিভিতে যাবেন সরকারের হয়ে কথা বলতে। হাসিনাও তাকে উৎসাহ দিয়ে বলেন, হেলিকপ্টার থেকে প্যারাস্যুট দিয়ে ছত্রীসেনা নামানো ও “সোজা বোম্বিং” করার বার্তা যেন ইনু দিয়ে আসেন।

ইনু জবাবে নিশ্চিত হয়ে নেন, এই বোমা মানে “সাউন্ড বোম্ব” বা স্টান গ্রেনেড। গত বছরের ডিসেম্বরে নেত্র নিউজের নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কীভাবে ১৯ জুলাই র‍্যাবের হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া স্টান গ্রেনেড মাথায় পড়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এক শিশুর মস্তক।

এই ধরনের নির্বিচার বলপ্রয়োগে হতাহত হয়েছে বহু মানুষ।

র‍্যাব ও পুলিশের তৎকালীন মহাপরিচালকের বক্তব্য নিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়। তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, র‍্যাবের হেলিকপ্টার থেকে ৭৩৮টি টিয়ার গ্যাস শেল, ১৯০টি সাউন্ড গ্রেনেড ও ৫৫৭টি স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল।

১৯ জুলাই ছাত্রলীগের এক নেতার সঙ্গে কথা হয় হাসিনার। আল জাজিরার প্রকাশিত তাদের অডিও আলাপচারিতায় শোনা যায়, হাসিনা স্বীকার করছেন যে, “বিটিআরসি বন্ধ করছে। এখন ইন্টারনেট বন্ধ।” কিন্তু পরক্ষণেই তিনি হাসতে হাসতে এর দায় আন্দোলনকারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল বাতলে দেন — “ব্রিটিশ হাই কমিশনার বোধ হয় জিজ্ঞেস করসে যে “এটা কবে ঠিক হবে?” এটা তোমরা বল আন্দোলন, কারফিউয়ে পোড়াইসে। এটা ঠিক হইতে অনেক সময় লাগবে।”

সরকারিভাবে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে ক্র্যাকডাউন চালানো হলেও তখন সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, আন্দোলনকারীদের ভাংচুর ও ইন্টারনেট ক্যাবল পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে ইন্টারনেট বন্ধ আছে। তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের উক্তি ছিল, “ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে।” তার এই বক্তব্য নিয়ে তখন ব্যাঙ্গবিদ্রুপ হয়েছিল ব্যাপক। সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে, বর্তমানে কারাগারে থাকা পলক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তখন ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার এই ফোনালাপ থেকে তা আরও স্পষ্ট হলো।

এই কথোপকথনের পরের কয়েকদিনে লাশের মিছিল আরও বড় হয়েছে। ২৯ জুলাই নাগাদ নিহতের সংখ্যা দুইশ’ ছাড়িয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন আরো শতাধিক মানুষ। কিন্তু তারপরও হাসিনার মনে হয়েছে, তিনি এতদিন স্রেফ ধৈর্য ধরেছেন।

সেদিন দুপুরে হাসিনার সঙ্গে কথা হয় তার উপ-সামরিক সচিব কর্নেল রাজীব আহমেদের। আল জাজিরা ও ডেইলি স্টারে প্রকাশিত সেই ফোনালাপে স্পষ্ট গলায় হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, “এবার আর কোনো কথা নাই। এবার একবারে শুরুত্তে দিবা। বলে দিলাম। ... ওরা গলিতে ঘুরতে থাকবে। শুরুতে ওই অল্প জমায়েত থাকলে, যা যা করার করতে হবে।”

কর্নেল আহমেদের জবাব ছিল, “ঠিক আছে, স্যার।”●

প্রতিবেদনে সহায়তা করেছেন আকিব মো. সাতিল। সুবিনয় মুস্তফী ইরনের ইলাস্ট্রেশন।